স্বপ্ন পূরণ

IMG_20220710_142125

“স্বপ্ন পূরণ”

আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন হতে বাইকের প্রতি আসক্ত। বলছি ৯০ দশকের শেষের দিকের কথা। ১৯৯৮-২০০০ এরকম হবে।

বাবা তখন ছোট একটা ব্যবসা করত। বাবার বেশ নাম-ডাক ছিল বলে এলাকার প্রায় সবকিছুতে বাবাকে ডাকত। হয়ত সেই সূত্র ধরেই বাবা ঘরে ওই সময়ে বাইক কিনে আনেন। ছোট ছিলাম তাই হয়ত ওটাতে একটু বেশি আসক্ত হয়ে গেছিলাম। প্রথম দিনের কথা বলতে গেলে তো আমি অনেকরাত অব্দি বাইকটার পাশ ছাড়ি নাই।

বাবা সন্ধ্যা নামায় সময় করে লাল টুকটুকে একটা ইয়া বড় যন্ত্র চালিয়ে নিয়ে আসে। এসে ঘরের উঠানে রেখে মুসকি হাসে আর মা’কে ডাকে। অদ্ভুত এক শব্দ শুনে আমরা ভাইরা খেলা ছেড়ে মা’য়ের ডাকের স্থলে নিজেরাই দৌড়ে গিয়ে সারা দিই বাবাকে। দেখি কি সুন্দর গাড়ি। দেখতে আমাদের খেলার সাথী গাড়িগুলোই মত হলেও বিশাল প্রকৃতির ছিল। সুন্দর একটা শব্দ হতো চালালে। চাকাগুলোও অসম্ভব বড় ছিল। মা-বাবা কথা বলতে বলতে ঘরে প্রবেশ করলেও আমার প্রবেশ করার মত ইচ্ছে শক্তি কেন জানি ছিলনা। গাড়িটার উপর বহু কষ্টে উঠে বসেছিলাম। তারপর চাবি দিয়ে অন না করেই খেলনার গাড়ির মত বু বু করছিলাম থুন’নি দিয়ে। সেই এক অন্যরকম মহূর্ত।

তারপর ঘুম আসত না। বাহিরে বেশি সময় বাইকটা বাড়িতে রাখত বলে ওটাই খেলার সাথী ছিল অধিকন্তু।  ওইটায় একমাত্র খেলার সাথী। সেই হতে বাইকে আসক্ত।

সময়ের সাথে ইচ্ছেরও পরিবর্তন। অনেকটা বড় হলাম। বুঝতে শিখেছিলাম। তাই হয়ও চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। নিত্য নতুন বাইক দেখা আর নিজের করার ইচ্ছে তৈরি হওয়া। কিন্তু বয়সে আর পরিবারের কারণে ইচ্ছে পূরণ অসম্ভব ছিল। টিউশন করা শুরু করলাম ইচ্ছে পূরণের জন্য। টাকা জমাচ্ছিলাম নিজের স্বপ্নের জন্যে। আমার নিজের টাকায় একটা বাইক হবে ভাবতেই অসম্ভব একটা খুশি কাজ করত।

তবে দু:খের বিষয় এই যে, অল্প অল্প টাকায় একটা কেনার মত টাকা জমা অসম্ভব ছিল। কিন্তু হাল ছাড়ি নাই। টিউশনের টাকা, বাজার খরচ হতে বাঁচানো টাকা, কোথাও যাওয়ার হলে ওখান হতে বাঁচানো টাকা ইত্যাদি বিভিন্নভাবে টাকা জমানোর চেষ্টা নিজেকে ব্যস্ত রাখছিলাম।

২০১২ সালের শেষের সময় দূর্গার পূজোর পরপরই আর অস্তিরতা সহ্য করতে না পেরে জমানোর ব্যাংকটা ভাংগা শুরু করি। গুনতে গুনতে ৬৭,৩০০+ মত টাকা পাই৷

কিন্তু একটা বাইক কেনার জন্য যা যথেষ্ট ছিলনা। তারপর অনেকটা ভয় নিয়ে বাবাকে আমার ইচ্ছে কথা শেয়ার এবং টাকাগুলো দিই। বাবা আমার দিক অবাক হয়ে থাকিয়ে ছিল অনেকক্ষন! আমি ভয়ে কথাগুলো এক লাইনে শেষ করে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে থাকি। বাবাও চুপ। হঠাৎ বাবা থুঁতনি নাড়ে। মা”কে ডাক দেই। মা’ও সাড়া দিলে বাবা তার সামনে আসতে বলে। আমার হাত পা কাপতে শুরু করল। মা’ আসতেই বাবা টাকাগুলো মা’য়ের হাতে দিয়ে পা এগুতে এগুতে হাসি দিয়ে বলে তোমার ছেলে অনেক বড় হয়ে গেছে; টাকাগুলো রাখ। আমি চাইলে দিও। আমি বাবার দিক মাথা তুলে তাকানোর সাহস পাচ্ছিলাম না তবুও কিন্তু আনন্দে বাবাকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছিল।

সন্ধ্যে নামবে প্রায়। গধূলী লগ্ন বয়ছিল। প্রায় সপ্তাহ দশ দিন পর বাবার নিজের বাইকটা না এনে অন্য আরেকটা বাইক নিয়ে বাড়ি আসে। বেশ বড় সর দেখতে। লাল টুকটুকে দেখতে। যেন নতুন বউ বাড়ি নিয়ে আসল। গাড়ি থেকেই বাবা মা’কে ডাক দেওয়ার সাথে সাথে মা’ পূজোর তালা হাতে বাবার সামনে হাজির। তখন আর বুঝতে দেরি নেই যে বাড়ির নতুন মেহমান তবে আসল। পূজো শেষে বাবা চাবিটা আমাকে দিয়ে বলে এলাকার বাহিরে যাওয়া নিষেধ আর অতিরিক্ত স্পিড নিষেধ।  আমি তো মহা-খুশি। তারপর পুরো এলাকায় না হয় ওইদিন ২০-৩০বার রাউন্ড দিয়েছি খুশিতে। সেই রাতের ঘুমটা অহেতুক খুশিতে আপ্লুত হয়েই নির্ঘুম কাটিয়েছিলাম।

সেই’দিন’ই নিজের কষ্টের জমানো টাকায় স্বপ্ন পূরণের যে আনন্দ আমি আমার বাবা-মায়ের সাথে পেলাম তা বলার বাহিরে।

তারপর বাড়িতে বাবার আর আমার ২ টা বাইক হলো। বাবা’তো নাম ও দিয়েছিল বাইকের। বাবার’টার বড় মিয়া আর আমার টা ছোট মিয়া। সেই সূত্র ধরে বাড়ির সবায় ওই নামে সম্মোধন করা শুরু করে।

এখন আমি আরো বলে হয়েছি। বাবাও আরো বৃদ্ধ হয়েছে। বাবার সেই পুরোনো বড় মিয়া থাকলেও আমার ছোট মিয়া এই কয়’বছরে অনেকবার পরিবর্তন হয়েছে। স্মৃতি হিসেবে বাবার’টা বাড়িতে এখনো আছে। শুধু মেরামত করা নয়। আর আমার ছোট মিয়া নিত্য নতুন ইচ্ছের প্রবণতা হলে পরিবর্তন হয়।

ইচ্ছে শক্তিতে অটুট থাকলে সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই ইচ্ছে পূরণ করবেন। সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস আর পরিশ্রম করে ইচ্ছে শক্তিতে অনল থাকা দরকার কেবল।

সবার সকল ছোট ছোট ইচ্ছে পূরণ হোক

✍️

 IB’94

Leave a Reply

Categories